সুনামগঞ্জ , বুধবার, ২২ জানুয়ারী ২০২৫ , ৯ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
বিশিষ্ট সমাজসেবক নূরুল হক মহাজন স্মরণে সভা ধর্মপাশায় প্রথম কিস্তির টাকা না পাওয়ায় বিপাকে পিআইসিরা উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নে কৃষক সমাবেশ সুনামগঞ্জ সীমান্তে এক বছরে ১০ মৃত্যু আটক দেশি-বিদেশি ৪৪ নাগরিক বিজিবি’র অভিযানে কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য জব্দ বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো ব্যবহারে সতর্কতা জারি দ্রুত গতিতে চলছে উড়াল সড়ক প্রকল্পের ৯ প্যাকেজের কাজ রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য ছাড়া সংস্কার প্রতিবেদন গ্রহণযোগ্য হবে না : ফখরুল আ.লীগকে নিষিদ্ধের পরিকল্পনা সরকারের নেই: প্রেস সচিব এক বছরে ৩১০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, ৪৬ শতাংশই স্কুল-পড়ুয়া জেলা পর্যায়ে আন্তঃকলেজ ফুটবল টুর্নামেন্ট উদ্বোধন যা সংস্কার করা দরকার, তা রাজনৈতিক সরকারই করবে : আসাদুজ্জামান রিপন হাওরে কমছে দেশি ধান চাষ আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা সে সিদ্ধান্ত জনগণের : মির্জা ফখরুল আগাছা রয়ে গেছে, আবারও যুদ্ধের প্রস্তুত নিন : জামায়াত আমির সরস্বতীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বিদ্যালয়ের জমি প্রভাবশালীর দখলে জেলা পর্যায়ে জাতীয় গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট উদ্বোধন দোয়ারাবাজার সীমান্তে ভারতীয় দুই নাগরিক আটক নির্বাচন করতে এত সংস্কার দরকার নেই : জয়নুল আবদিন ফারুক ঘোষণাপত্র নিয়ে ‘তড়িঘড়ি’ করার বিপক্ষে রাজনৈতিক দলগুলো

কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ কমরেড বরুণ রায়

  • আপলোড সময় : ০৮-১২-২০২৪ ১২:৫০:২৯ অপরাহ্ন
  • আপডেট সময় : ০৮-১২-২০২৪ ১২:৫০:২৯ অপরাহ্ন
কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ কমরেড বরুণ রায়
সুব্রত দাশ আমি মানুষের চরণধুলো পেয়েছি। তারাই সত্যিকারের মানুষ; দেশপ্রেমী এবং সত্যাশ্রয়ী। আমার প্রতি ভালোবাসা দেখে তাদের হয়ে কাদামাটিতে থেকেছি, কখনও দূরে যাইনি। আমার জীবনবোধের বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছি। এ-জনতাই স্বাধীন করেছে দেশ, হটিয়ে দিয়েছে স্বৈরশাসকের দানব শক্তি। একদিন অর্থনৈতিক বিজয় মানুষের হবেই..... বরুণ রায়। একজন মানুষকে বারবার জেলে যেতে হচ্ছে। জেলে জেলে কেটে গেল জীবনের চৌদ্দটি বছর। হুলিয়া মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে থাকতে হয়েছিল তাকে। জমিদার তনয় হয়েও দুঃখ-দারিদ্রের সাথে করতে হয়েছে বসবাস। পিতার মৃত্যুর খবর জেলখানায় বসে শুনতে হয়েছিল। তবুও মেলেনি মুক্তি। কিন্তু কেন! অপরাধ একটাই ছিল তাঁর, মানুষকে বড্ড ভালোবাসতেন তিনি। গরীব দুঃখী অসহায় মানুষের প্রতি হৃদয়মথিত ভালোবাসার এক অমোঘ বন্ধনে জড়িয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে। যে সাম্যের পৃথিবী গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন শৈশবেই পিতার চোখে। সেই স্বপ্নের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছেন আজীবন অকুতোভয়, নিঃশঙ্কচিত্তে। কখনও কক্ষচ্যুত হননি। সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর বিশ্বাস ও ভালোবাসা শেষদিন পর্যন্ত ছিল অটুট। তিনি চিরবিপ্লবী কিংবদন্তি বামরাজনৈতিক নেতা কমরেড প্রসূনকান্তি রায়। বরুণ রায় নামেই যিনি সকলের কাছে আদৃত, সমধিক পরিচিত। বরুণ রায়ের জন্ম ১৯২২ সালের ১০ নভেম্বর ভারতের বিহার রাজ্যের পাটনায়। সেখানে তাঁর পিতামহ কৈলাশচন্দ্র রায় শিক্ষাবিভাগের সেক্রেটারি (সচিব) পদে চাকরিরত ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯২৩ সালে পিতামহ সরকারি চাকরি হতে অবসর নিয়ে নিজ গ্রাম সুনামগঞ্জের বেহেলিতে চলে আসেন এবং গ্রামে এসে খামার ও জমিদারি দেখাশুনা করতে থাকেন। করুণাসিন্ধু রায়ের মাধ্যমে তাঁর পরিবারে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মনোভাব গড়ে ওঠে। করুণাসিন্ধু রায় কলকাতা হিন্দু কলেজে পড়াশুনা করাকালে সুভাষ চন্দ্র বসুকে সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন। বাবার কাছ থেকেই বরুণ রায় রাজনীতির অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই নিজগ্রাম বেহেলিতে নানা রাজনৈতিক কর্মকা- দেখতে দেখতে তিনি বড় হয়েছেন। ১৯৪২ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি কমিউনিস্ট পাটির পূর্ণাঙ্গ সদসপদ লাভ করেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, বিভিন্ন কৃষক আন্দোলন, ঐতিহাসিক সিলেটের নানাকার বিদ্রোহ (‘নান’ ফারসি শব্দ যার অর্থ রুটি, ‘কার’ অর্থ কাজ। নানকার প্রজা বলতে বুঝায় খাদ্যের বিনিময়ে শ্রম প্রদানে বাধ্য প্রজা। রুটি দিয়ে যে লোক রাখা হয় তাকেই নানকার বলে। যারা জমি বাড়ি ভোগের বিনিময়ে জমিদার বা মিরাশদারের সার্ক্ষণিক চাকর হয়ে থাকবে। কাজের বিনিময়ে শুধু খাবার জুটবে কোন অর্থ পাবে না।), ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, হাওরাঞ্চলের ভাসানপানি আন্দোলনসহ নানা আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে গরীব মেহনতি মানুষের কল্যাণে, একটি শোষণহীন, সাম্য সমাজের বিনির্মাণে ব্রতি ছিলেন জীবনভর। দেশ বিভাগকালে বরুণ রায় ছিলেন ছাত্র ফেডারেশনের সিলেট জেলা স¤পাদক। ছাত্র ফেডারেশন ছিল কমিউনিস্টদের ছাত্রফ্রন্ট। তখনও দুর্ভিক্ষ কাটেনি। ফ্যাসিবাদী আন্দোলনও তুঙ্গে। সেই সময় (১৯৪৫) হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ে দেখা দেয় মহামারি আকারে ম্যালেরিয়া। এই মহামারিতে প্রায় দশ হাজারের বেশি লোক মারা যায়। তখন ছোট ছোট বহু জনপদ মানবশূন্য হয়ে পড়ে। বানিয়াচংয়ে ম্যালেরিয়ার ভয়ে হাটবাজার বন্ধ থাকে। শবদাহ করার বা কবর দেওয়ার মতো মানুষও পাওয়া যায়নি। এই ঘোরতর মহাবিপদে কমিউনিস্ট পার্টি, সুরমা উপত্যকা সাংস্কৃতিক স্কোয়াড ও গণনাট্যের কর্মীরা বানিয়াচংয়ে তাবু করে দীর্ঘ ৪৫ দিন একটানা সেবাব্রতি হয়ে কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে বরুণ রায়ও ছিলেন। এ সেবা কাজের সময় অর্ধাহার, অনাহার ও দীর্ঘমেয়াদী নির্ঘুমের কারণে শেষপর্যন্ত বরুণ রায়ও জ্বরে (টাইফয়েড জাতীয়) আক্রান্ত হয়ে পড়েন। শেষপর্যন্ত তাকে টানা তিন বছর নিজ বাড়িতে শয্যাশায়ী থাকতে হয়। ১৯৪৮ সালে এম.সি. কলেজের ছাত্র হিসেবে তিনি ভাষা আন্দোলনে শরিক হন। এ বছরই ৮ মার্চ সিলেটের গোবিন্দচরণ পার্কে (বর্তমান হাসান মার্কেট) বাংলা ভাষার সপক্ষে এক সভা আহ্বান করা হয়। সে সভার কাজ শুরু হতে না হতেই উর্দুপন্থিরা সভা ভ-ুল করার চেষ্টা চালায়। তারা সভাপতিকে স্থানচ্যুত করে সে আসন দখল করে নেয়। হামলাকারীরা সভার আয়োজকদের প্রতি ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে। এ দিন গুন্ডাবাহিনীর ইট পাটকেলের আঘাতে বরুণ রায় আহত হন। এর কিছুদিন পর ১৯৪৮ সালেই একই স্থানে কৃষক প্রজার সমর্থনে এক সমাবেশে বক্তৃতা দেয়ার সময় পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে নিয়ে যায়। জেলে থাকার সময় তাঁর জীবনে চারটি স্মরণীয় ঘটনা ঘটে বলে তিনি তার সংগ্রামী স্মৃতির মোহনায় গ্রন্থে উল্লেখ করেন। প্রথমটি হলো: ২৬মার্চ ১৯৪৯ সালে সুনামগঞ্জের কৃষক আন্দোলনের নেতা অগ্নিপুরুষ রবি দামকে পাক পুলিশ সুনামগঞ্জের মহেশখলা অঞ্চলে গুলি করে হত্যা করে। দ্বিতীয়ত: রবি দাম হত্যার পর তাঁর বাবা করুণাসিন্ধু রায়ের আত্মগোপনে চলে যাওয়া এবং আত্মগোপনে থাকাবস্থায় অসুস্থ হয়ে বিনাচিকিৎসায় মৃত্যুবরণ। অনেক পরে বাবার মৃত্যু সংবাদ পাওয়া ও বাবার জন্য কিছু করতে না পারার দুঃখবোধ। তৃতীয়ত: রাজশাহী খাপরা ওয়ার্ডে বন্দীদের হত্যা। তখন মি. গিল জেল সুপার ছিলেন। তার নেতৃত্বে পুলিশের গুলিতে ৭ জন কমিউনিস্ট সেদিন প্রাণ হারিয়েছিল। চতুর্থত: ভাষা আন্দেলনের সূচনা ও মহান বিজয় অর্জন। তিনি ১৯৫৩ সালে সিলেট জেল থেকে ছাড়া পান; একটানা দীর্ঘ পাঁচ বছর কারাভোগের পর। বাড়িতে ফিরে আসার পর ৫৩ সাল পর্যন্ত তাঁকে বাড়িতে অন্তরীণ রাখা হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে এম.এল.এ. নির্বাচিত হন। নির্বাচনে জেতার পরই তাঁকে আবারও গ্রেফতার করা হয়। সিলেট জেল থেকে দ্রুত ঢাকা জেলে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে বঙ্গবন্ধু ও তিনি একই কক্ষে ছিলেন। তিনি বলেন, আমি কমিউনিস্ট এবং তিনি (বঙ্গবন্ধু) জাতীয়তাবাদী নেতা। আমরা রাজনৈতিক কথাবার্তা নিয়ে আলাপ করে সময় কাটাতাম। তখনই বুঝেছিলাম তিনি বড় হৃদয়ের মানুষ এবং বড় মাপের নেতা। সাধারণ মানুষ সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল খুবই স্পষ্ট ও মানবিক। পাকিস্তান যে একদিন ভেঙ্গে পড়বে তাও তাঁর কথা ও পরিকল্পনা থেকে বুঝেছিলাম। ১৯৫৫ সালে তিনি ছাড়া পান। ১৯৫৬ সালে সিলেটে পুলিশরা তাদের সমস্যার জন্য ধর্ঘট করে সে ধর্ঘঘটের উস্কানিদাতা ও যোগাযোগের অভিযোগে তাঁকে আবারও গ্রেফতার করা হয়। আতাউর রহমান প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি মুক্তি পান। ১৯৫৮ সালে আইয়ূবের মার্শাল ল’ ঘোষণার সময় প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করার আগেই তাকে সামরিক জান্তার লোকজন গ্রেফতার করে। এভাবে তিনি সিলেট-ঢাকা-রাজশাহী প্রভৃতি জেলে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত কাটান। পাকিস্তান আমলে বন্দীদের ওপর করা নানা অত্যাচারের কথা আমরা জানি। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, পাকিস্তান আমলে আমাকে মারপিট করা হতো। আমার পিঠে ৬৩ টা দাগ রয়েছে। ফজলুল করিম এ দাগগুলো দেখে আমার ওপর এমন একটা লেখা লিখেছেন [তখন রাজশাহী জেলে তিনি ও সর্দার ফজলুল করিম একসঙ্গে ছিলেন]। আমি নিজেও পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ১৯৬৪ সালে নির্বাচনের পূর্বে তিনি ছাড়া পান। ছাড়া পেয়ে আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৬৫ সালের ১ জানুয়ারি তার নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু হলে গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যান। তখন বিশেষত দুর্গম হাওরাঞ্চলে তিনি নানা ছদ্মবেশে ধরে থাকতেন এবং নীরবে-নিভৃতে কাজ করে যেতেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে এসে দিরাই-শাল্লা অঞ্চলের লোকদের নিয়ে এক জনসমাবেশ করেন। স্মরণীয় সেই সমাবেশে চল্লিশ হাজার লোক উপস্থিত হয়েছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ন্যাপের প্রার্থী হিসেবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এম.পি.এ. হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসার মূল কারিগর ছিলেন বরুণ রায়। মহান মুক্তিযুদ্ধে বরুণ রায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সশস্ত্র যুদ্ধের পরিকল্পনা, ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সেনাদের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শরণার্থীদের ক্যা¤প তৈরি, খাদ্য বস্ত্রের ব্যবস্থাকরণ, অস্ত্র সংগ্রহসহ নানামুখীকাজে নেতৃত্ব দেন। তিনি ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি -ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সালে বরুণ রায় কমিউনিস্ট পার্টি থেকে ৮ দলের প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। নানা অজুহাতে ১৯৮৭ সালে সামরিক শাসক বিনাওয়ারেন্টে তাকে গ্রেফতার করে এবং নীতিবিবর্জিতভাবে একজন সংসদ সদস্যকে কয়েদিদের মতো থাকতে দেয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা তাঁকে প্রার্থী হওয়ার জন্য অনুরোধ করলে তিনি নিজে প্রার্থী না হয়ে তাঁরই পার্টির (কমিউনিস্ট পার্টি) সদস্য নজির হোসেন এর জন্য ছেড়ে দেন। নজির হোসেন জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। তখন বিএনপি জোট ক্ষমতায় গেলে কমরেড নজির হোসেন বিএনপিতে যোগদান করে তার কমরেডত্ব ঘুচিয়ে একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন! লেখক রণদীপম বসু ‘আমার প্রথম জীবনের গুরু’ শীর্ষক ছোট্ট একটি লেখায় বরুণ রায়ের শিষ্য(!) নজির হোসেনের এমন পরিবর্তনের বিষয়টিকে কমরেড বরুণ রায়ের জীবনের একমাত্র রাজনৈতিক পরাজয় বলে তাঁর ব্যক্তিগত মতামত তুলে ধরেন। হাওরে আশির দশকে মৎস্যজীবীদের অধিকার আদায়ে বরুণ রায় ‘ভাসান পানি’ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। উন্মুক্ত ভাসান পানিতে মাছধরার অধিকার অরজিত হলেও ‘জাল যার জলা তার’ নীতি আজও কাযর্করী হলো না। ইজারা প্রথার মাধ্যমে আজও প্রকৃত মৎস্যজীবীগণ জলমহালের প্রাপ্য সুবিধা হতে বঞ্চিত। বরুণ রায় যেমন মানুষকে ভালবাসতেন, তাঁরাও তাঁকে তেমনি ভালোবাসতো। তিনি বাস করতেন সাধারণ মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়। প্রান্তিক মানুষেরা তাকে সবসময় বিপদে আপদে আগলে রেখেছেন। যেকারনে হুলিয়া মাথায় নিয়ে টিকটিকিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। তিনি ছিলেন পথ প্রদর্শক, তাঁর পথ অনুসরণ করে কতশত কর্মী আজও গান সাম্যের গান, সব ধরনের লোভ লালসার ঊর্ধ্বে ওঠে। শাল্লার বাহারা ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান রামানন্দ দাস তাঁদেরই একজন। তাঁর সাথে একদিন প্রসঙ্গেক্রমে বরুণ রায়কে নিয়ে আমার কথা হয়। সেদিন দেখিছি তাঁর চোখে ভালোবাসার অশ্রুবিন্দু। তিনি ছিলেন একজন কিংবদন্তি, রূপকথার নায়ক। তাঁকে নিয়ে কবি ও গবেষক, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক তাঁর এক লেখায় শৈশবের বিস্ময়ানুভূতির কথা ব্যক্ত করেছেন, ‘বরুণদা জমিদার পরিবারে জন্ম নেন। কিন্তু গরিব দুঃখী মানুষের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে তারই অংশ হিসেবে তিনি ডি-ক্লাসড হন। অর্থাৎ নিজের শ্রেণি থেকে বের হয়ে শ্রেণিহীন মানুষের মধ্যে মিশে যান। বিপ্লবী হয়ে ওঠেন। এবং এই অপরাধে তাঁকে পুলিশ প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায়। তিনি এক রূপকথার রাজপুতরের মতো কোটাল পুত্রদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য মাঠে ময়দানে অরণ্যে-আড়ালে পালিয়ে বেড়ান। ...আমি শুধু বিস্ময়াভিভূত বালকের মুগ্ধতা নিয়ে এসব কাহিনী শুনতাম। একবার নাকি বরুণদা পুলিশের হাতে প্রায় ধরা পড়ার অবস্থা। গ্রামের প্রান্তসীমায় পুলিশ তাড়া করছে। গ্রামবাসীও ভয়ে দৌড়াচ্ছে। এর মধ্যে পুলিশ হঠাৎ দেখে রাস্তায় একজন লোক লুঙ্গি তুলে তাদের দিকে পশ্চাৎদেশ দিয়ে প্রাকৃতিক কর্ম সারছে। একদম মূল রাস্তার মধ্যে। পুলিশ খুবই বিরক্ত হয়। লোকটিকে লাথি দিয়ে সরিয়ে দিয়ে তারা বরুণদাকে ধরার জন্য সামনের দিকে এগিয়ে যায়। পুলিশ জানত না, যাকে তারা লাথি দিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়ে সামনে দৌড়াচ্ছে - তিনিই ছিলেন বরুণদা। শৈশবে এই রূপকথা শুনেই আমরা বড় হয়েছি।’ গণমানুষের কবি দেলোয়ার এই উপমহাদেশে কমরেড বরুণ রায়ের মতো ব্যক্তির জন্মগ্রহণকে একাধারে মহাপ্রাকৃতিক আশীর্বাদ এবং মর্মস্পর্শী লীলা বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন এভাবে, ‘আশীর্বাদ’ এই কারণে যে, বরুণ রায় সাম্যবাদের হাত ধরে জীবন বসন্তকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। ...অন্যদিকে “মর্ম¯পর্শী লীলা” বলতে আমি এ কথাই বোঝাতে চেয়েছি যে, মানুষের উত্তরাধিকার নিয়ে যারা জন্মগ্রহণ করেন, ধর্মীয় ভেদ বুদ্ধিতে আকীর্ণ কোনও ভূখ-ে তাদের জন্মগ্রহণ এক ধরনের অভিশাপ ছাড়া আর অন্য কিছু নয়।’ গরিবের বন্ধু, কিংবদন্তি এই রাজনীতিবিদ ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। লাল সালাম কমরেড। সূত্র: ১। প্রসূনকান্তি রায় (বরুণ রায়), অনুলিখন: দীপংকর মোহান্ত, সংগ্রামী স্মৃতির মোহনায়, ২। পার্থ সারথি দাস, শামস শামীম, কমরেড বরুণ রায়ের সর্বশেষ সাক্ষাৎকার আমার পিঠে ৬৩ টা দাগ রয়েছে, ৩। মো. আবদুল আজিজ, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সিলেট, ৪। রণেন্দ্র তালুকদার পিংকু, স¤পাদনা, কমরেড প্রসূনকান্তি বরুণ রায় স্মারকগ্রন্থ, ৫। সুখেন্দু সেন, স¤পাদনা পর্ষদ আহ্বায়ক, বরণীয় বরুণ রায়। [সুব্রত দাশ, আইনজীবী, জজ কোর্ট, সিলেট; কোষাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ, সিলেট জেলা শাখা]

নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha

কমেন্ট বক্স
বিশিষ্ট সমাজসেবক নূরুল হক মহাজন স্মরণে সভা

বিশিষ্ট সমাজসেবক নূরুল হক মহাজন স্মরণে সভা